২৫শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৩রা রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

হাসিনা-তাপসের ফোনালাপে উঠে এসেছে যেসব ভয়ংকর তথ্য

জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন এভাবেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফোনালাপ প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশের মানুষও শুনেছেন তাদের কথোপকথন। 

বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শেখ হাসিনার মামলার ২২তম কার্যদিবসের সাক্ষ্যগ্রহণ ছিল। 

এদিন ৫৩তম সাক্ষী হিসেবে বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহার জবানবন্দি রেকর্ড করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেল। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে সাক্ষীর দাখিল করা চারটি ফোনালাপ বাজিয়ে শোনানো হয় ট্রাইব্যুনালে। যার প্রথমটিই ছিল হাসিনা-তাপসের ফোনালাপ।

তাদের সেই কথোপকথনে উঠে এসেছে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনের চাঞ্চল্যকর তথ্য। এমনকি মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশনাও দিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী।

কথোপকথনটি পাঠকের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো—

শেখ হাসিনা : হ্যালো।

তাপস : জি, সালামালাইকুম।

শেখ হাসিনা : হ্যাঁ, ওয়ালাইকুম আসসালাম। 

তাপস : জি।

শেখ হাসিনা : বলো বাবা, তুমি নরমাল ফোনে কল দেও, ইন্টারনেটের অবস্থা ভালো না।

তাপস : নরমাল ফোনেই, নরমাল ফোনেই। 

শেখ হাসিনা : আচ্ছা বলো বাবা।

তাপস : জি, সন্ত্রাসীরা তো বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন সময় ঘুরতেছে, এখন কোথায় কি আক্রমণ করে যাচ্ছে না তো।

শেখ হাসিনা : না, আমরা ওদের ব্যবস্থা নিচ্ছি, আমি। আর আবাহনী ক্লাবে কি আগুন দিছে?

তাপস : ওরা মনে হয় সচিবালয়ে আক্রমণ করছে, আবাহনী ক্লাবেও।

শেখ হাসিনা : কোথায়?

তাপস : সচিবালয়ে তো আক্রমণ করছে, আপনি জানেন না।

শেখ হাসিনা : না

তাপস : হ্যাঁ, স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী তো ওখানে আছে। সচিবালয়ে কয়েকবার ওরা আক্রমণ করছে। ওরা তো রাতে যদি আবার কোথাও কোথাও বিভিন্ন সংবেদনশীল বাসা বাড়িতে আক্রমণ করে তাহলে তো ইয়ে হবে।

শেখ হাসিনা : রাতের বেলা সব ভিজিলেন্স থাকবে। আচ্ছা ঠিক আছে আমি এখনই ব্যবস্থা নিচ্ছি। একটু আস্তে আস্তে অনেক জায়গায় গেদারিং ক্লিয়ার হচ্ছে।

তাপস : ওরা মনে হচ্ছে না ইয়ে করবে, রাতে মনে হয় ওদের আরও অনেক কিছু পরিকল্পনা আছে, মনে হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো আমাকে তাই বলল, আভাস দিল। আপনাকেও মনে হয় বলছে কিছু, রাতে যদি সর্বোচ্চ না ইয়ে করে করবেন নাকি?

শেখ হাসিনা : কি করব?

তাপস : মানে সেনাবাহিনী দিবেন?

শেখ হাসিনা : বাবা, একটু চিন্তা করে কথা কইও।

তাপস : জি

শেখ হাসিনা : এটাই তাদের আকাঙ্ক্ষা।

তাপস : বুঝতেছি আমি টেকনিক্যালি এইটা বুঝতেছি। কিন্তু ওরা মনে হয় ওই পথে নেওয়ার জন্য ইয়ে করছে।

শেখ হাসিনা : দরকার নাই, ওটা দরকার নাই। আমি সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা বলছি ওরা রেডি থাকবে, ঠিক আছে, এখনতো আমরা অন্য ইয়ে করতেছি। ড্রোন দিয়ে ছবি নিচ্ছি আর হেলিকপ্টারে ইয়ে হচ্ছে মানে কয়েক জায়গায়। 

তাপস : তাহলে ওই কিছু ছবি দেখে পাকড়াও করা যায় না, রাতের মধ্যে।

শেখ হাসিনা : সবগুলোকে আটক করতে বলেছি, রাত্রে।

তাপস : হ্যাঁ, পাকড়াও করলে ওদেরকে।

শেখ হাসিনা : না ওটা বলা হয়ে গেছে, ওটা নিয়ে র‍্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআই সবাইকে বলা হইছে যে যেখান থেকে যে কয়টা পারবা ধইরা ফেলো

তাপস : জি

শেখ হাসিনা : ওটা বলা আছে, আর যেখানে গেদারিং দেখবে সেখানে ওই ওপর থেকে, এখন ওপর থেকে করাচ্ছি, অলরেডি শুরু হইছে কয়েকটা জায়গায়।

তাপস : জি।

শেখ হাসিনা : হইয়া গেছে।

তাপস : জি জি, মোহাম্মদপুর থানার দিকে মনে হয় ওরা যাচ্ছে এটা আমাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

শেখ হাসিনা : মোহাম্মদপুর থানার দিকে।

তাপস : হ্যাঁ।

শেখ হাসিনা : ওখানে পাঠাইয়া দিক র‍্যাব।

তাপস : জি, তাহলে আপনার নির্দেশনা লাগবে।

শেখ হাসিনা : আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে, ওপেন নির্দেশনা দিয়ে দিছি, এখন লিথাল ওয়েপন ব্যবহার করবে। যেখানে পাবে সোজা গুলি করবে।

তাপস : জি

শেখ হাসিনা : ওটা বলা আছে। আমি এতদিন বাধা দিয়ে রাখছিলাম। ওই যে স্টুডেন্টরা ছিল ওদের স্ট্যাডির কথা চিন্তা করে। তারপর তো। 

তাপস : না রাতে স্টুডেন্ট না, রাতে হলো ওরা সন্ত্রাসী।

শেখ হাসিনা : কি করছ তোমার, ওই যে আমাদের রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলের একটা বাচ্চা ছেলে, তার শিক্ষক তাকে ডাইকা নিয়ে আসছে, শিক্ষক নাকি আবার শিবির করত, ওরা জানে না। তারপর সেই ছেলেটা মারা গেছে, তার মাত্র বুকে একটা গুলি অথচ পুলিশ কিন্তু কোনো রিভলবার ব্যবহার করেনি।

তাপস : হ…জি।

শেখ হাসিনা : এরকম ঘটনা তারা ঘটাইছে।

তাপস : জি, আপনি সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ইয়ে করেন।

শেখ হাসিনা : সব জায়গায় আগুন.. বিআরটি, বিটিআরসি বন্ধ করে দিছে, পোড়াইয়া দিছে, বিটিভি পোড়াইয়া দিছে, এখনতো ইন্টারনেট বন্ধ। সব পোড়াইয়া দিছে, এখন চলবে কিভাবে।

তাপস : জি, এটা ভালো হইছে, জি।

শেখ হাসিনা : না পোড়াইয়া দিছে, মেশিনপত্র সব পুড়ে গেছে। আমি বলছি যা যা পোড়াতে.., ও আমাদের সেতু ভবন পোড়াইছে।

তাপস : জি, ওরা রাতে মনে হয় আরও ব্যাপক আক্রমণ করবে।

শেখ হাসিনা : হ্যাঁ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সেটা পোড়াইছে।

তাপস : জি, কারণ এই যে আমি ফিরলাম। আমি দেখলাম যে রাস্তায় রাস্তায় ওরা বিভিন্ন জায়গায় ইয়ে করতেছে।

শেখ হাসিনা : কোন কোন জায়গায়?

তাপস : বনানীতে। বনানী-গুলশানে তো সচরাচর করে না। কিন্তু বনানী-গুলশানে ওরা ইয়েতে চলে আসছে… কোথাও কোথাও ইয়ে করতে পারে, মুভমেন্ট আছে সব জায়গায়।

শেখ হাসিনা : ঠিক আছে, আমি দেখছি।

তাপস : জি

শেখ হাসিনা : তোমরা সাবধানে থেক।

তাপস : জি, আমি সাবধানে আছি।

শেখ হাসিনা : আচ্ছা।

তাপস : ধরপাকড় করতে হবে। সব ধরে ফেলতে হবে, রাতের মধ্যে।

শেখ হাসিনা : না না ওটা বলে দেওয়া আছে অলরেডি। আর একটু আর একটু রাইত গাঢ় হলেই শুরু হবে।

তাপস : জি, জি।

শেখ হাসিনা : অন্য ব্যবস্থা নিচ্ছি।

তাপস : জি, জি।

শেখ হাসিনা : আচ্ছা।

তাপস : সালামালাইকুম।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একপর্যায়ে এ মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদঘাটনে রাজসাক্ষী হন সাবেক আইজিপি। এরই মধ্যে সাক্ষ্যও দিয়েছেন তিনি। আজ সকালেও তাকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়েছে। তার উপস্থিতিতেই জবানবন্দি দিচ্ছেন সাক্ষীরা। এ মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলেও যুক্তিতর্ক পর্ব শুরু হবে বলে জানিয়েছে প্রসিকিউশন।
ট্রাইব্যুনালে আজ প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম, ফারুক আহাম্মদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যান্যরা।

সর্বশেষ