২৫শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৩রা রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতায় কতটা অস্বস্তিতে ভারত

এখন থেকে মাসছয়েক আগেকার কথা, মাস্কাটে ইন্ডিয়ান ওশান কনফারেন্সের অবকাশে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর বৈঠকে বসেছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে।

আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট বা ‘সার্ক’কে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার প্রসঙ্গ তোলা হয়, যেটি সে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের একটি সুপরিচিত অবস্থান।

এর আগে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও একাধিকবার সার্ককে জিইয়ে তোলার কথা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, যে প্ল্যাটফর্মের কার্যক্রম প্রায় এক দশক হলো স্থবির হয়ে রয়েছে।

কিন্তু মাস্কাটের বৈঠক মি জয়শংকর পরিষ্কার জানিয়ে দেন, সার্কের কথা আপাতত না তোলাই ভালো – কারণ কোন দেশটির কারণে আর কেন সার্ক অচল হয়ে আছে, সেটা জোটের সদস্য দেশগুলোর ভালো মতোই জানা।

শুধু তাই নয়, সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলা মানে সেটাকে ভারত যে ‘পাকিস্তানের সুরে সুর মেলানো’ হিসেবেই দেখবে, সেটাও বলেন মি জয়শংকর।

এর দিনকয়েক বাদেই দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানান, “আমরা বাংলাদেশকে আরও বলেছি, তারা যেন সন্ত্রাসবাদকে ‘নর্মালাইজ’ করার, বা স্বাভাবিক ঘটনা বলে তুলে ধরার কোনো চেষ্টা না করে!

ভারত যেখানে সার্কের হয়ে কথা বলাকেও পাকিস্তানের হয়ে সওয়াল করা হিসেবে দেখছে – সেখানে ঢাকা ও ইসলামাবাদের ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক ঘনিষ্ঠতা যে দিল্লিকে অস্বস্তিতে ফেলছে, তা সহজেই অনুমেয়!

মাস্কাটে সেই বৈঠকের পরবর্তী কয়েক মাসে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ শুধু কাছাকাছিই আসেনি, প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, সংস্কৃতি বা যোগাযোগ – প্রায় সব খাতেই দুই দেশের সহযোগিতা নিবিড় থেকে নিবিড়তর হয়েছে।

সেই ফেব্রুয়ারিতেই বাংলাদেশ বহু বছরের মধ্যে প্রথমবার পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানি করে, দুই দেশের মধ্যে আবার শুরু হয় সরাসরি বাণিজ্য।

এরপর উদ্যোগ নেওয়া হয় ভিসা বিধিনিষেধ শিথিল করার এবং ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে ডিরেক্ট ফ্লাইট চালু করার। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া ও সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথাও জানায় পাকিস্তান।

দু’দেশের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারাও একে অপরের দেশে যেতে শুরু করেন, সেই সব সফরের ছবিও প্রকাশ করা হতে থাকে।

এই ধারাবাহিকতাতেই সদ্য বাংলাদেশ সফর করে গেলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তথা উপপ্রধানমন্ত্রী ইশহাক দার, যিনি তার সফরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস-সহ অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে তো বটেই – বিএনপি, জামায়াত বা এনসিপি-র শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও দেখা করেছেন।

এমন কী ইশহাক দার বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে একাত্তর বা গণহত্যার মতো স্পর্শকাতর ইস্যু নিয়েও কথা বলতে দ্বিধা করেননি, এটিকে একটি ‘মীমাংসিত বিষয়’ বলে দাবি করে তিনি বাংলাদেশিদের ‘হৃদয় পরিষ্কার করে’ সামনে এগিয়ে যাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন।

ঘটনাপ্রবাহের এই গতি আর আকস্মিকতা ভারতকে রীতিমতো উদ্বেগে ফেলেছে।

পাকিস্তানের সামরিক কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ সফর কিংবা করাচি থেকে চট্টগ্রামে পণ্যের চালান নিয়ে এর আগে যখনই ভারত সরকারকে প্রশ্ন করা হয়েছে, মুখপাত্র বাঁধাধরা জবাব দিয়েছেন, ‘আমাদের নিরাপত্তা পরিবেশে প্রভাব ফেলতে পারে, এমন যে কোনো ডেভেলপমেন্টের দিকেই আমরা সতর্ক নজর রাখি।’

কিন্তু ভারতের কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকদের অনেকেই এখন ঢাকা-ইসলামাবাদের এই নতুন আঞ্চলিক সমীকরণ তাদের স্বার্থকে কীভাবে ব্যাহত করতে পারে এনিয়ে খোলাখুলি কথা বলছেন।

ভারতের প্রধান সেনাধ্যক্ষ (চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ) জেনারেল অনিল চৌহান পর্যন্ত গত মাসে প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছেন, চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের (নিরাপত্তা) স্বার্থের ক্ষেত্রে এক ধরনের ‘অভিন্নতা’ দেখা যাচ্ছে – ভারতের জন্য যার প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী।

জেনারেল চৌহান বলেন, ‘এই তিনটি দেশের ক্ষেত্রে যে সম্ভাব্য ‘কনভার্জেন্স অব ইন্টারেস্ট’ দেখা যাচ্ছে, তা ভারতের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা ডায়নামিক্সের ওপর বড় প্রভাব ফেলতেই পারে!’

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কাছাকাছি আসাকে ভারত এখন ঠিক কীভাবে দেখছে, কোন কোন ঘটনা তাদের বিচলিত করছে এবং কেন – এই প্রতিবেদনে তারই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।

সর্বশেষ