বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা রেখেছেন, এমন অনেকেই আগে ভোটার হলেও স্থানীয় বা জাতীয় কোনো নির্বাচনে ভোট দেননি। এবার তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচনে ভোট দেবেন বলেছেন। তাদের কেউ কেউ প্রার্থীও হয়েছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন ঘিরে এমন উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
তারা বলছেন, ভোটের কথা শুনলেও তারা কখনও ভোটকেন্দ্র কিংবা নির্বাচনি পরিবেশ দেখেননি। ভোট নিয়ে তাদের মধ্যে ‘নেতিবাচক’ মনোভাবও ছিল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এমন অনেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে, যারা প্রথম কোনোধরনের নির্বাচনি আমেজ দেখছেন।
জুলাই অভ্যুত্থানে পটপরিবর্তনের পর এবার তারা প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চান, হোক না সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোট।
ফাইরুজ ফেরদৌস, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। শামসুননাহার হলের এ শিক্ষার্থী বলছেন, জীবনে প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন কোনো নির্বাচনে, আর এবারই প্রথম প্রার্থী হয়েছেন।
তিনি বলেন, হল সংসদ নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন ভিপি পদে।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার বাসিন্দা এ শিক্ষার্থীর ভাষ্য, আগে কখনও তিনি ভোট দেননি এবং ভোটের কেন্দ্রও দেখেননি।
ফাইরুজ বলেন, “প্রথমবারের মতো কোনো নির্বাচনে ভোট দেব। এ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা অনেক নায্য দাবি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাদের দাবি দাওয়া কিছুটা হলেও পূরণে যেন কাজ করতে পারি, সেজন্য নির্বাচনে অংশ নিয়েছি।”
ফাইরুজের সঙ্গে বুধবার চাকসু ভবনে গিয়েছিলেন তার বিভাগের সহপাঠী ফারজানা ইয়াসমিন পুতুল।
পুতুল বলেন, “আগে কখনো জাতীয় কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটে দিতে যাইনি। পরিবেশ দেখে আগ্রহও হয়নি, ভোট দিতে যাওয়ার। এবার কোনো নির্বাচনে প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করব।”
সিংঞোইউ মারমা, নবাব ফয়েজুন্নেসা হলের আবাসিক এ ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। জিএস পদে নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। ‘হৃদ্যতার বন্ধন’ প্যানেল থেকে নির্বাচনে অংশ নেবেন তিনি।
রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার বাসিন্দা সিংঞোইউ মারমা বলেন, “এটাই আমার জীবনের প্রথম ভোট। আগে কোনো নির্বাচনে ভোট দিই নাই। জীবনে প্রথম ভোট দেব, পাশাপাশি প্রার্থীও হয়েছি। নিজের মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্যরকম আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমাদান নিয়ে সরগরম হয়ে উঠেছে চাকসু ভবন।
শাটল ট্রেন থেকে ফ্যাকাল্টি, ক্লাস রুম থেকে ঝুপড়ি সবখানেই চলছে নির্বাচনের আমেজ।
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর আয়োজন করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ও হল সংসদ নির্বাচন। আগামী ১২ অক্টোবর নির্বাচনের জন্য চলছে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমাদানের কাজ।
১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল সর্বশেষ চাকসু নির্বাচন। এরপর বিভিন্ন সময়ে চাকসু নির্বাচন নিয়ে আলোচনা উঠলেও তা আর ভোট পর্যন্ত গড়ায়নি।
গত বছরের ৫ অগাস্ট ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এ সরকারের বিরুদ্ধে বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচন ও স্থায়ী সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ রয়েছে।
দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে।
সাড়ে তিন দশক আগে যখন চাকসু নির্বাচন হয়েছে, তখন বর্তমান শিক্ষার্থীর কারো জন্মই হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. মারুফ হাসান চাকসু ভবনে এসেছিলেন তার সহপাঠী আবদুর রশীদ রাব্বীর, যিনি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। রাব্বী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আবদুর রব হল সংসদের এজিএস পদে নির্বাচন করছেন।
পাবনার ছেলে মারুফ বলেন, “জাতীয়ভাবে ভোটার হয়েছি। কিন্তু কখনও নির্বাচনে ভোট দিতে যায়নি। এবার প্রথম ভোট দিব, আর বন্ধু নির্বাচন করছে। সব মিলিয়ে আমার অনুভূতিটা অন্যরকম।”
শহীদ আবদুর রব হল সংসদের সদস্য পদে মনোনয়নপত্র জমা দিতে এসেছিলেন ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী তাহমীদ ফাত্তাহা। তার সঙ্গে ছিলেন তিন সহপাঠী। তাদের মধ্যে দুইজন কোনো নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেননি বলেছেন।
তাহমীদের মনোনয়নপত্রে সমর্থক হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন সৈয়দ মুনতাসির মাহমুদ।
ফেনীর দাগনভূঞা এলাকার বাসিন্দা মুনতাসির
ফেনীর দাগনভূঞা এলাকার বাসিন্দা মুনতাসির বলেন, “চাকসু নির্বাচনে অন্যরকম একটা আমেজ পাচ্ছি আমরা। আমাদের বন্ধু নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। তার নির্বাচনি ফরমে সমর্থক হিসেবে স্বাক্ষর করেছি, সব মিলিয়ে আমাদের অন্যরকম অনুভূতি।”
তাদের সঙ্গে থাকা লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বাসিন্দা ফাহিম ইকবালও বলেছেন, চাকসু নির্বাচনেই তিনি প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যাচ্ছেন।
“আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু না হলেও আমরা আমাদের বন্ধুর জন্য প্রচারের কাজ করছি।”
এর আগে চাকসুর সবশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি।
গেল ২৮ অগাস্ট চাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। তফসিল অনুযায়ী, ১৬ সেপ্টম্বর মনোনয়নপত্র গ্রহণের এবং ১৭ সেপ্টেম্বর জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল। এখন তা একদিন বাড়ল।
মনোনয়নপত্র জমাদান শেষে ২১ সেপ্টেম্বর প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা এবং ২৫ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে। এর আগে ২৩ সেপ্টেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা যাবে। তার পরের দিন প্রার্থীতা নিয়ে আপত্তি গ্রহণ নিষ্পত্তি হবে।
চাকসু নির্বাচনের আচরণবিধি অনুযায়ী, ২৫ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করার পর ভোটগ্রহণের ২৪ ঘণ্টা আগ পর্যন্ত প্রচার চালানো যাবে। সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে প্রচার চালানোর কথা বলা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৯টি বিভাগ ও পাঁচটি ইনস্টিটিউটের ২৭ হাজার ৬৩৪ শিক্ষার্থীর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে চাকসু নির্বাচনের ওয়েবসাইটে। তবে হল ভিত্তিক তালিকা এখনও প্রকাশ করা হয়নি।
চাকসুতে ২৬টি পদের ২১টি সম্পাদকীয় পদ, আর পাঁচটি নির্বাহী সদস্যের পদ রয়েছে। প্রতিটি হল সংসদে পদের সংখ্যা ১৫।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ১৪টি হল ও একটি হোস্টেল রয়েছে, তার মধ্যে পাঁচটি ছাত্রীদের এবং ১০টি ছাত্রদের।